এই অধ্যায় পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মুদ্রার ইতিকথা, বিবর্তন এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। তাছাড়া মুদ্রার ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যাংকের সাথে মুদ্রার সম্পর্ক সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে।
এ অধ্যায় পাঠে শিক্ষার্থীরা মুদ্রার বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকের সৃষ্টি এবং ব্যাংকব্যবস্থা ও ব্যাংকার সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে। এই অধ্যায়ে ব্যাংকের ব্যবসায়িক ইতিহাস এবং ক্রমবিকাশ আলোচনা করা হয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং তার ইতিকথা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
মানব সৃষ্টি ও সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজন, কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক বন্ধনের পরিধি প্রসার লাভ করতে থাকে। প্রথমে মানুষের চাহিদা ছিল খুব সীমিত এবং পরস্পরের মধ্যে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে নিজের চাহিদা নির্বাহ করতো। দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য' এই প্রথাটি বিনিময় প্রথা (Barter System) হিসেবে পরিচিত।
পর্যায়ক্রমে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির পরিধি বাড়ার সাথে সাথে মানুষের কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে বিনিময় কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে এবং সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যার পিছনে ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা এবং পরবর্তীতে জাহাজের অবদান অসামান্য। যোগাযোগের অসুবিধা দূর হওয়ার সাথে সাথে ভৌগোলিক বিভিন্ন অবস্থান থেকে প্রয়োজনমতো দ্রব্যাদি সংগ্রহের চেষ্টা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
গ্রাম থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর এবং দেশ থেকে দেশে দ্রব্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে একটি বিনিময় মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা প্রবলভাবে অনুভূত হতে থাকে। বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়াও সঞ্চয়ের ভাণ্ডার এবং মূল্যের পরিমাপক হিসেবে মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা মুদ্রা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
মুদ্রার ইতিহাস খুবই বিচিত্র। ইতিহাস থেকে দেখা যায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকার এবং প্রকৃতির মুদ্রা বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হতো। বিনিময় মাধ্যমে মুদ্রা হিসেবে বিভিন্ন সময় কড়ি, হাঙ্গরের দাঁত, হাতির দাঁত, পাথর, ঝিনুক, পোড়া মাটি, তামা, রুপা ও সোনার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
ব্যবহার, স্থানান্তর, বহন এবং অন্যান্য প্রয়োজনের কারণে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ধাতব মুদ্রা ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ধাতব পদার্থের সরবরাহ ঘাটতি দেখাদেয়, তাছাড়া স্বর্ণ এবং রৌপ্যের অলংকারাদিসহ অন্যান্য ব্যবহারের কারণে কাগজি মুদ্রার প্রচলন ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়। বর্তমানে কাগজি মুদ্রার সাথে সাথে ধাতব মুদ্রার প্রচলন থাকলেও ধাতব মুদ্রার ব্যবহার এখন ক্রমশ সীমিত হয়ে আসছে। কাগজের সহজলভ্যতা, সহজে বহনযোগ্য হওয়া এবং বর্তমানে বিভিন্ন রকমের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় কাগজি মুদ্রা ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে।
কার্যকারিতার ভিত্তিতে মুদ্রা বলতে আমরা বুঝি, 'মুদ্রা একটি বিনিময় মাধ্যম, যা সবার নিকট গ্রহণীয় এবং যা মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের বাহন হিসেবে কাজ করে'। এই সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মুদ্রা নিম্নলিখিত কর্ম সম্পাদন করে :
সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষের সামাজিক বন্ধন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মানুষের মধ্যে লেনদেন এবং বিনিময়ের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। মুদ্রা প্রচলনের পরপরই ব্যাংক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যার জন্য মুদ্রাকে ব্যাংক ব্যবস্থার জননী বলা হয়। ব্যাংক ব্যবস্থা বিবর্তনের প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাংক মুদ্রাকেই তার ব্যবসার প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
মানুষের কাছে থাকা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ তার সঞ্চয় হিসাবে সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যাংক তার আমানতের সৃষ্টি করে, যার বিনিময়ের সঞ্চয়কারী একটি নির্দিষ্ট সুদ বা মুনাফা পেয়ে থাকে। এই আমানত ঋণগ্রহীতাকে ঋণ হিসাবে বর্ধিত সুদে প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংক তার ব্যবসায়িক মুনাফা লাভ করে থাকে। মুদ্রা ছাড়া যেমন ব্যাংক চলতে পারে না, তেমনি ব্যাংক ছাড়া মুদ্রার ব্যবহারও সীমিত।
ব্যাংক:
ব্যাংক শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কঠিন। ব্যাংক শব্দটির আভিধানিক অর্থ কোনো বস্তুবিশেষের স্তূপ, কোষাগার, লম্বা টেবিল হিসেবেও এই শব্দের বিস্তৃতি আছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, প্রাচীন ল্যাটিন শব্দ Banco, Bangk, Banque, Bancus প্রভৃতি শব্দ থেকেই Bank শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। এই মতে অনুসারীদের যুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক শব্দের ল্যাটিন অর্থ বেঞ্চ অথবা বসবার জন্য ব্যবহৃত লম্বা টেবিল, যার সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় সমর্থন পাওয়া যায়।
মধ্যযুগীয় অর্থনীতির ইতিহাসে দেখা যায় ইতালির Lombardy Street-এ একশ্রেণির লোক একটি লম্বা টুল বা বেঞ্চে অর্থ জমা রাখা এবং অর্থ ধার দেওয়ার ব্যবসা পরিচালনা করত, যা ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকায়ও একইভাবে পরিচালিত হতো। তাই ব্যাংক শব্দটির ল্যাটিন উৎপত্তির পেছনে বেশি সমর্থন দেখতে পাওয়া যায়।
ব্যাংকের সংজ্ঞা বলতে গেলে আমরা বলতে পারি, এটি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করে এবং মুনাফা অর্জনের নিমিত্তে বিনিয়োগ করে এবং চাহিবামাত্র অথবা নির্দিষ্ট সময়াস্তে সঞ্চয়কারীর কাছে ফেরত দিতে বাধ্য থাকে।
ব্যাংকিং :
অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, 'ব্যাংক হচ্ছে, অর্থ জমা, তোলা এবং ঋণ দেয়ার একটি নিরাপদ প্রতিষ্ঠান । ব্যাংকিং শব্দটি ব্যাংকের কার্যাবলির একটি বিস্তৃত ধারণা অর্থাৎ ব্যাংকের সকল আইনসঙ্গত কার্যাবলি ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত। ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি যা ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত তা নিম্নরূপ:
ব্যাংকার :
ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালনার সাথে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে ব্যাংকার বলা হয়। ব্যাংক এবং ব্যাংকার শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যাংক এবং ব্যাংকিং কার্যাবলি ব্যাংকের নিজের পক্ষে পরিচালনা করা সম্ভবপর না হওয়ায় ব্যাংকিং বিষয়ে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালিত হয়।
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে মানুষ তার অতিরিক্ত আহরিত এবং উৎপাদিত পণ্য অন্যের সাথে বিনিময়ের মাধ্যমে নিজের প্রয়োজন নির্বাহ করত, দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্যের এই বিনিময় প্রথা বহুদিন প্রচলিত ছিল, বর্তমান ব্যবস্থায় বিনিময় প্রথা (Barter System) স্বল্প পরিসরে প্রচলিত আছে। মুদ্রা আবিষ্কারের পর পর ব্যবসা বাণিজ্য, লেনদেন এবং মুদ্রার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা থেকে ব্যাংক ব্যবস্থার সৃষ্টি বলে জানা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে প্রথম ব্যাংক ব্যবস্থা ইতিহাসে স্থান করে নেয়। পরবর্তীকালে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা ব্যাংকিং ব্যবসাকে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনে খ্রিষ্টপূর্ব চারশ সাল পর্যন্ত অবদান রাখে। ভারত অঞ্চলে প্রথম আধুনিক ব্যাংক হিসাবে দি হিন্দুস্তান ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭০০ সালে। পরে ১৯৩৫ সালে ভারতের সকল ব্যাংকের প্রধান হিসেবে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রসারে এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানদের নেতৃত্ব দান করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের উৎপত্তির সাথে সাথে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রতিষ্ঠিত (যা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হতে কার্যকর) হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ১২টি ব্যাংকের ১০৯০টি শাখা কর্মরত ছিল। কিন্তু ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন এবং ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের মালিক ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের মালিকগণ অবাঙালি হওয়ায় এবং তাদের প্রধান অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবসা মুক্তিযুদ্ধের পর পর প্রচণ্ড সংকটে নিপতিত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা প্রচলন, ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকিং ব্যবসার অভিভাবকের রূপালী ব্যাংক, দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং সব ব্যাংকের জাতীয়করণ করেন, যার কারণে নিম্নলিখিত ৬টি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জন্ম লাভ করে। এগুলো হলো: সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংক। পরে এদের মধ্যে শুধু সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক ছাড়া সবগুলোই ক্রমশ বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। সত্তরের দশকেই অনুধাবন করা যায় যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। আশির দশকে শুরু হয় বিরাস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া। আশির দশকের পরেই নব্বই দশক পরবর্তীতে বেসরকারি খাতে আরও কিছু নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪টি সরকারি, ৪টি বিশেষায়িত এবং ৩০টির অধিক বেসরকারি ব্যাংক কার্যকর আছে।